ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার বনপাড়া আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজে বর্তমানে ৯০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও অফিস সহায়ক কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে অধ্যক্ষসহ ৫৫ জনেরই নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে কলেজ শাখায় কর্মরত ৭০ জনের মধ্যে ৫০ জনের সনদই জাল। আর স্কুলের নন-এমপিওভুক্ত পাঁচজনের সনদ জাল। বিধিবহির্ভূত পদ্ধতিতে তাদের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়; এমপিওভুক্তির কাগজপত্রেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছিল। এছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ভুয়া প্রতিনিধি দেখিয়ে নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়।
সম্প্রতি আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজে নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ, প্রভাষক, প্রদর্শক, সহকারী শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে তদন্ত করা হয়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জান্নাতের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়ে ↑ ওই প্রতিবেদনে অধ্যক্ষ মো. ইমদাদুল হক অনিয়মের মূল পরিকল্পনাকারী বলে সূত্র জানায়।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বনপাড়া আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজে কর্মরত অবস্থায় পাঁচজন প্রভাষক একসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সরকারের কাছ থেকে দুই জায়গার বেতন-ভাতা নিয়েছেন। তারা হলেন- ব্যবসা সংগঠনের মুহাম্মদ আজিজুল হক, রসায়নের মো. হাবিবুল্লাহ হাসান, ইংরেজির মো. আবু রায়হান, আইসিটির মোস্তাফিজুর রহমান এবং গণিতের বিপুল দেবনাথ।অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক নিজেও প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষের দুই পদেও সরকারি বেতন ভাতা উত্তোলন করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অধ্যক্ষ মো. ইমদাদুল হক তাঁর প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন। কলেজ শাখার ৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারী এবং স্কুল শাখার আরও পাঁচজনের নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক থেকে শুরু করে সবগুলো পদেই অনিয়ম করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, অধ্যক্ষ ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন বলে উল্লেখ করলেও সেখানে অধ্যয়ন করেছেন-এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তার কাগজপত্র যাচাইয়ে দেখা গেছে, সংযুক্ত সনদটি জাল। একইভাবে কলেজের প্রভাষক মো. কামরুল ইসলাম ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে জাল সনদ ব্যবহার করে নিয়োগ পান। প্রভাষক মুহাম্মদ আজিজুল হক ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন।ভূগোল ও পরিবেশের প্রভাষক লুবনা জাহান, অর্থনীতির হাফিজুর রহমান, কৃষি শিক্ষার জাবরুল ইসলাম, যুক্তিবিদ্যার রেহানা পারভীন, মনোবিজ্ঞানের নাসরিন আক্তার, মৃত্তিকা বিজ্ঞানের খাইরুল বাশার, শিল্পকলা ও বস্ত্র পরিচ্ছেদের হাফিজুল ইসলাম, চারু ও কারুকলার সিদ্দিকুন নাহার, পরিসংখ্যানের আলমগীর হোসেন, আরবির সেলিম, গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের শাহানাজ পারভীন, খাদ্য ও পুষ্টির ফারহানা সুলতানা, সংস্কৃতর বিউটি রানী সরকার, পালির শেফালী খাতুন, শিশুর বিকাশের মোস্তফা হাসান, নাট্যকলার ফারুক খান, গৃহ ব্যবস্থাপনা ও পারিবারিক জীবনের ফজলুল হক, উচ্চাঙ্গ সংগীতের ইসমে তারা, লঘু সংগীতের শফি কামাল, ক্যারিয়ার শিক্ষার মনিফা খাতুন, প্রকৌশল অঙ্কন ও ওয়ার্কশপ প্র্যাকটিসের চাঁদ সুলতানা মনি, উদ্যোক্তা উন্নয়নের কুদরাত উল্লাহ, ক্রীড়ার ইসমাইল হোসেন, মানবসম্পদ উন্নয়নের ফরিদ আহম্মদ-সবাই স্ক্যান করা স্বাক্ষর ও জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরি নিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
সূত্র জানায়, কৃষি শিক্ষা, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, নাট্যকলা,শিশুর বিকাশ, খাদ্য ও পুষ্টি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, ক্যারিয়ার শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, গৃহ ব্যবস্থাপনা, প্রকৌশল অঙ্কনসহ অনেক বিষয়ে কলেজে কোনো অনুমোদনই ছিল না। এমনকি অনেকে আনন্দমোহন কলেজের নামে সনদ দেখালেও সেই কলেজে ওই বিষয়ে অনার্সই চালু ছিল না।
সূত্র জানায়,তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নুপুর রানী মিশ্র, পদার্থবিজ্ঞানের ফাতেমাতুজ জোহরা, রসায়নের মোহাম্মদ সোহাগ মিয়া, প্রাণিবিজ্ঞানের আফরিন জাহান, কম্পিউটারের মাহফুজুর রহমান, সহকারী গ্রন্থাগারিক রেফাজ উদ্দিন, শারীরিক শিক্ষার পলাশ চন্দ্র সরকার, সহকারী গ্রন্থাগারিক আহসান উল্লাহ, উদ্ভিদবিজ্ঞানের ল্যাব সহকারী শাফিকুল ইসলাম, শেফালী বেগম, প্রাণিবিজ্ঞানের ল্যাব সহকারী রাজু আহমেদ, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. আবু রায়হান, আসাদুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল ফাহিম, অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী তামিমা আক্তার, অফিস সহায়ক আরিয়ান হাসান, রাকিবুল হাসান রনি, সুজন মিয়া, জুয়েল মিয়া, আমিনুল ইসলাম, রিফাত হাসান, নিরাপত্তাকর্মী মোস্তফা কামাল ও জাকারিয়া ইসলাম-সবাই অনিয়ম করে নিয়োগ পেয়েছেন।
সূত্র জানায়, এমপিওবিহীন পাঁচ শিক্ষক-রায়হানা ইয়াসমিন (সমাজবিজ্ঞান), এ.এইচ.এম. রাকিবুল আলম (ব্যবসায় শিক্ষা), ঝুমুর দেবনাথ (সমাজবিজ্ঞান), রেহেনা পারভীন (সমাজবিজ্ঞান) এবং তাহমিনা সুলতানা শাম্মী (কম্পিউটার ল্যাব)-এর নিয়োগও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী হয়নি।
তদন্তে প্রতিবেদনে অনুযায়ী জানা যায়, বনপাড়া আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজে কর্মরত অবস্থায় পাঁচজন প্রভাষক একসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সরকারের কাছ থেকে দুই জায়গার বেতন-ভাতা নিয়েছেন। তারা হলেন- ব্যবসা সংগঠনের মুহাম্মদ আজিজুল হক, রসায়নের মো. হাবিবুল্লাহ হাসান, ইংরেজির মো. আবু রায়হান, আইসিটির মোস্তাফিজুর রহমান এবং গণিতের বিপুল দেবনাথ। একইভাবে অধ্যক্ষ ইমদাদুল হকও প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ-দুটি পদে থেকেই সরকারি বেতন ভাতা উত্তোলন করেছেন।
সূত্র জানায়, এমপিওভুক্তির কাগজপত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষর স্ক্যান করে বসানো হয়, যার বিষয়ে ইউএনও অবগত ছিলেন না। নিয়োগ কমিটিতে ডিজি প্রতিনিধির স্বাক্ষরও জালভাবে ব্যবহৃত হয়। ম্যানেজিং কমিটির দুই সভাপতি-মো. ওয়ারিছ উদ্দিন সুমন ও মো. মজিবুর রহমান লিখিতভাবে জানিয়েছেন, তাঁরা যথাক্রমে ২০ জন ও ৪ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন, কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, অধ্যক্ষসহ মোট ৯০ জন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, যার ৭৬ জন এমপিওভুক্ত।
সূত্র জানায়,অভিযোগে উল্লিখিত ও তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী নিয়োগগুলো সম্পূর্ণ বিধি বহির্ভূত, জাল সনদ ও জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংঘটিত। তাই কলেজ শাখার ৫০ জন এবং স্কুল শাখার পাঁচজন শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল করা এবং এদের বেতন-ভাতা বাবদ উত্তোলিত সরকারি অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।